ওবায়দুর রহমান, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি :
ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিববাড়ি যুব অর্ভ্যথনা ক্যাম্পে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবক সুলতান উদ্দিন তালুকদার স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভূক্ত হননি। মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাহত মানুষের সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিটি বিজয়ের ৫৩বছরে এসেও নিজের অধিকার থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। গেজেটভুক্ত করার দাবি পরিবারের।
যুদ্ধকালীন সময়ের বর্ণনা দিয়ে তাঁর স্ত্রী আছিয়া সুলতানা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাড়ি-ঘরে থাকতে পারি নাই। দুই সন্তানকে কোলে আর পেটে আরেক সন্তানকে নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়েছি। স্বামী মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছে, জানার পর কেউ আশ্রয় দিতে চায়নি। কেউ একদিন থাকতে দিলে, পরের দিন না করে দিয়েছে। স্বামী ফিরে আসবে কি-না; তাও জানা ছিলো না। তিনি বলেন, স্বামী দেখে যেতে পারেনি নিজের নামটি মুক্তিযোদ্ধা তালিকায়; আমি কী দেখে যেতে পারবো?
তিনি আরো বলেন, আমার স্বামীর নাম মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে গেজেটভুক্ত হবে, এটা কারো দয়া বা করুণা নয়, এটা হলো আমার স্বামীর কাজের স্বীকৃতি। এ স্বীকৃতি না পেলে পহেলা মার্চ থেকে আমিও আন্দোলনে নামবো। আমি আমরণ অনশন করবো। এ কথাগুলো বলতে গিয়ে বারবার আঁচলে মুখ মুছেন আছিয়া সুলতানা। সুলতান উদ্দিন তালুকদার মৃত্যুর সময় পাননি রাষ্ট্রীয় মর্যাদাও। ২০০৪ সালের ৯মে চিরবিদায় নেন।
তাঁর জন্ম ১৯৪৮সালের ৩১জানুয়ারি। ছাত্রাবস্থায় লেখাপড়া ছেড়ে তিনি চলে যান মুক্তিযুদ্ধে।
যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন বাঁচাতে সুলতান উদ্দিন তালুকদার ছিলেন সর্দাপ্রস্তুত। ক্যাম্পে সকল মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট পরিচিত এক নাম ছিলো সুলতান। এ ক্যাম্পে দায়িত্ব পালনের জন্য মুজিবনগর সরকারের একজন ভাতাভোগীও ছিলেন। ১৯৭১সালের ১৫নভেম্বর তারিখে ৭৫টাকা সর্বশেষ ভাতাও উত্তোলন করেন তিনি। ভাতাভোগীর ১১জনের মধ্যে তাঁর ক্রমিক নং ৯। এ তালিকার ১০জনই মুক্তিযোদ্ধা গেজেটভূক্ত। শুধু গেজেটভূক্ত হয়নি সুলতান উদ্দিন তালুকাদারের নাম। এছাড়াও আরো একটি মুক্তিযোদ্ধা তালিকা (অর্ন্তভূক্তি) ৪০জনের যে তালিকা প্রস্তুত হয় সেখানে সুলতান উদ্দিন তালুকদারের নাম ১৫নং ক্রমিকে।
এ তালিকার অনেকেই গেজেটভুক্ত হয়েছেন। হয়নি সুলতান উদ্দিন তালুকদারের নাম। তার বড় ছেলে মহি উদ্দিন তালুকদার লিটন জানান, মুক্তিযুদ্ধ করেছে আমার বাবা বিজয়ের ৫৩বছরেও তালিকাভূক্তি না হওয়ায় দুঃখজনক। অপর পুত্র কামরুজ জামান স্বপন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় মা এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি দৌড়েছে আশ্রয়ের জন্য আর আজ স্বীকৃতির জন্য এ দফতর থেকে ও দফতরে যাচ্ছি আমরা, আসলে যুদ্ধাটা শেষ হলো কোথায়?
স্বামীর মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতির জন্য ২০০৬সালে প্রথম আবেদন করেন আছিয়া সুলতানা। এরপর থেকে বারবার এ দপ্তর, ওই মন্ত্রণালয় ঘুরতে ঘুরতে আজ তিনি ক্লান্ত। সাক্ষাতকার ও যাছাই বাচাইয়ের আসরে যেতে যেতে তিনিও হাঁপিয়ে উঠেছেন। আছিয়া সুলতানার বয়সও ৭০’র কোটা ছাড়িয়েছে। শরীরে বাসা বেঁধেছে বার্ধ্যকজনিত নানা রোগ।
১৯৭২সালের ৯ ফেব্রুয়ারিতে ভারতের শিববাড়ি ইয়ূথ ক্যাম্পের ইনচার্জ ডা: এম.এ সোবহান প্রত্যয়নে লিখেছেন, মোঃ সুলতান উদ্দিন তালুকদার ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিববাড়ী যুব শিবিরে ১৯৭১ সালের মে মাসে যোগ দেন। ১৬ডিসেম্বর বিজয় ঘোষণা পূর্বপর্যন্ত তিনি ছিলেন এই ক্যাম্পে।
শিবিরে দীর্ঘকাল অবস্থানকালীন সময়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধকে সর্বাধিক মূল্যবান ও যুদ্ধাহতদের নিরলসভাবে সেবা দেন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এমসিএ হাতেম আলী মিয়া দেয়া প্রত্যয়নপত্রে লিখেন শিবিরে তাঁর দীর্ঘ অবস্থানকালে তিনি সর্বাধিক সেবা ও মুক্তির উদ্দেশ্যে কাজ করেন। সুলতান উদ্দিন তালুকদার মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিমাসে ৭৫ রুপী সম্মানী ভাতা পেতেন। তিনি এ প্রত্যয়ন প্রদান করেন ১৯৭৭সালের ৭ ফেব্রুয়ারিতে।
স্বামীর নামটি গেজেটভূক্ত করতে সর্বশেষ ২০১৪সালের ২২মে অনলাইনে আবেদন করেন আছিয়া সুলতানা। আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৭সালের ২৭জুন যাছাই বাচাই হয়। সেই যাছাই-বাচাই কমিটি সাক্ষ্য ও মুক্তিযোদ্ধার প্রামাণ্য দলিলের ভিত্তিতে ৬জনকে তালিকাভূক্ত করার জন্য সুপারিশ করেন। এ তালিকার ১নং ক্রমিকে ছিলো সুলতান উদ্দিন তালুকাদারের নাম। অন্য পাঁচজন তালিকাভূক্ত হলেও বাদ পড়েন শুধু তিনি। ২০২০সালের ১৯জানুয়ারি প্রকাশিত তালিকায়ও তাঁর নাম তালিকাভূক্ত হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কদ্দুছ বলেন, যে তালিকার ৫জন হলো সেই তালিকার এক নম্বর ক্রমিকের নাম বাদ পড়ে কিভাবে? মুক্তিযুদ্ধ করার পরেও তালিকায় নাম উঠানোর জন্য আরেকটা যুদ্ধ করতে হবে এটা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং লজ্জাজনকও। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমা-ার আব্দুর রহিম জানান, যাছাই-বাচাই কমিটি কর্তৃক সর্বসম্মতিক্রমে তার স্বীকৃতির জন্য জোর সুপারিশ করা হয়েছে। বিষয়টি আপিল বিভাগে রয়েছে।